১৯৯৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। কাবুল থেকে ১৫০ কিলোমিটার পূর্বের প্রদেশ নানগারহারের রাজধানী জালালাবাদে জন্ম নেন রশিদ খান আরমান, যাকে গোটা ক্রিকেটবিশ্ব রশিদ খান নামেই চেনে। দশ ভাইবোনের মধ্যে রশিদের অবস্থান ষষ্ঠ। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু হলে পুরো পরিবারকে নিয়ে তার বাবা পাড়ি জমান পাকিস্তানে। সেখানে তাদের ঠাঁই হয় রিফিউজি ক্যাম্পে। কিছুকাল সেখানে অবস্থান করার পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হলে সপরিবারে আবার তারা জন্মভূমি আফগানিস্তানে ফিরে আসেন।
ছোট্ট বালক রশিদ খানের তখনও ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয়নি। একদিন বসে টিভিতে খেলা দেখছিলেন। হঠাৎ তার নজর কাড়ল শহীদ আফ্রিদির বোলিং অ্যাকশন, তার হেয়ার স্টাইল একইসাথে উইকেট পাওয়ার পর তার আইকনিক উদযাপন। বালক রশিদের কোমল মনে আফ্রিদির নান্দনিক লেগ স্পিন গভীর দাগ কাটলো। স্বপ্ন দেখতে লাগলেন বড় হয়ে আফ্রিদির মতো লেগ স্পিনার হওয়ার। বাড়ির আঙিনায় সাত ভাইয়ের সাথে টেপ টেনিস ক্রিকেট দিয়ে শুরু হল রশিদ খানের ক্রিকেটীয় যাত্রা।
আফগানিস্তানের ক্রিকেট কাঠামো বলতে সেসময় উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিলনা। ক্রিকেটের সরঞ্জাম জোগানোটাই যেখানে ছিল কষ্টসাধ্য, সেখানে ক্রিকেট একাডেমির সাথে উন্নত সুযোগ সুবিধা আশা করাটা বড্ড বাড়াবাড়িই বটে! তবে প্রতিকূলতা দিয়ে তো প্রতিভাকে সবসময় দমিয়ে রাখা যায়না। ব্যক্তিগত উদ্যোগেই ঘন্টার পর ঘন্টা লেগ স্পিন প্র্যাকটিস করতে লাগলেন, সেই সাথে চললো নিবিড় ব্যাটিং অনুশীলন।
২০১৫ সাল। আফগানিস্তান ততদিনে বিশ্ব ক্রিকেটে মোটামুটি সমীহ জাগানিয়া দল হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। এমনি এক সময় আসন্ন জিম্বাবুয়ে সফরের জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পড়ে সতেরো বছর বয়সী রশিদ খানের। সেই সফরেই প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের দরজা খুলে যায় তার, অভিষিক্ত হন ওয়ানডেতে। প্রথম ম্যাচে আহামরি পারফরম্যান্স শো না করলেও বল হাতে একটি উইকেট লাভ করে দলের জয়ে ভূমিকা রাখেন। ওয়ানডে অভিষেকের সাতদিন পরই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই আন্তর্জাতিক টি টুয়েন্টিতে অভিষেক ঘটে তার।
ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ৭১ টি ওয়ানডে খেলে ব্যাট হাতে ১৯.২৫ গড়ে করেছেন ৯০৫ রান (হাফ সেঞ্চুরি ৪ টি) এবং বল হাতে ১৮.৫৪ গড়ে নিয়েছেন ১৩৩ উইকেট (৫ উইকেট- ৪ বার, সেরা বোলিং- ৭/১৮)। আন্তর্জাতিক টি টুয়েন্টি খেলেছেন ৪৮ টি, যেখানে এই লেগ স্পিনার হাত ঘুরিয়ে মাত্র ১২.৬২ গড়ে নিয়েছেন ৮৯ উইকেট (৫ উইকেট- ২ বার, সেরা বোলিং- ৫/৩)!
জাতীয় দলে অভিষেকের পরের বছরই তার সামনে সুযোগ আসে অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে খেলার। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের সে আসরে রশিদ খান ছিলেন করিম জানাতের সঙ্গে যৌথভাবে আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। সেই বিশ্বকাপে ৬ টি ম্যাচে মাঠে নেমে শিকার করেন ১০ উইকেট। অসাধারণ সেই পারফরম্যান্সের সুবাদে ভারতে অনুষ্ঠিত ২০১৬ টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপের আফগান স্কোয়াডেও জায়গা পেয়ে যান তিনি। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
২০১৬ সালকে রশিদের ক্যারিয়ারের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কারণ, সে বছরই তিনি আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি টুয়েন্টিতে মাত্র ৩ রান দিয়ে ৫ উইকেট শিকার করে লাইমলাইটের আলোয় নিজেকে নিয়ে আসার পাশাপাশি ক্রিকেটবিশ্বে হৈ চৈ ফেলে দেন। সেবছর ভারতে অনুষ্ঠিত টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপেও তার পারফরম্যান্স ছিল নজরকাড়া। তাছাড়া একই বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এক ওয়ানডে ম্যাচে ১৮ রানের বিনিময়ে তুলে নেন ৭ উইকেট, যা আজ অবদি তার ক্যারিয়ারসেরা বোলিং।
ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে বছর না ঘুরতেই বিভিন্ন ফ্রাঞ্চাইজি লীগে রশিদের ডাক আসতে থাকে। ২০১৭ সালে আইপিএলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আফগান ক্রিকেটার হিসেবে নাম লেখান মোহাম্মদ নবী এবং রশিদ খান। ৫০ লাখ রুপি ভিত্তিমূল্যের রশিদকে দলে নেওয়ার জন্য সানরাইজার্স হায়াদ্রাবাদকে গুনতে হয় ৪ কোটি রুপি! অনেকের কাছে বিষয়টি সমালোচিত হলেও হায়াদ্রাবাদ যে তাকে কিনে ভুল করেনি, তার প্রমাণ তিনি মাঠেই দিয়েছিলেন। সে আসরে ১৪ ম্যাচে ওভারপ্রতি মাত্র ৬.৩৫ ইকোনমি রেটে শিকার করেছিলেন ১৭ উইকেট! রশিদের এমন পারফরম্যান্সে পরবর্তী আসরে ৯ কোটি রুপির চুক্তি করে তাকে দলে রেখে দেয় সানরাইজার্স হায়াদ্রাবাদ।
২০১৮ সালে টেস্ট খেলুড়ে দেশের রাজকীয় তালিকায় স্থান করে নেয় আফগানিস্তান। ১৪ জুন, ২০১৮। নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টেস্ট ফর্মেটে খেলতে নেমে আফগানরা প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় ভারতকে। প্রথম ইনিংসে রশিদ খান ১৫৪ রান দিয়ে মাত্র ২ উইকেট তুলে নিতে সক্ষম হন, আফগানরা হেরে যায় বিশাল ব্যবধানে। শুরুটা বাজে হলেও পরবর্তী টেস্টগুলোতে স্বমহিমায় ফিরে আসতে সক্ষম হন তিনি।
দেখে নেওয়া যাক রশিদ খানের ক্যারিয়ার হাইলাইটস, রেকর্ডস এবং অন্যান্য -
★ রশিদ খান প্রথম ক্রিকেটার, যিনি আন্তর্জাতিক টি টুয়েন্টিতে দুই ওভারে পাঁচ উইকেট শিকার করেন।
★ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এক ওয়ানডে ম্যাচে তিনি ৪৩ রান দিয়ে ৬ উইকেট শিকার করেন। একই ম্যাচে ৬ উইকেট শিকার করেন আইরিশ ক্রিকেটার পল স্টার্লিং। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উভয় দলের বোলারের ৬ উইকেট নেওয়ার ঘটনা এটিই ছিল প্রথম।
★ ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসে প্রথম হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্ব তার, যা ছিল তার ক্যারিয়ারেরও প্রথম হ্যাটট্রিক।
★ মাত্র ১৭ বছর ৩৬ দিন বয়সে আন্তর্জাতিক টি টুয়েন্টিতে অভিষিক্ত হন রশিদ, যা ছিল তৎকালীন সময়ে আফগানিস্তান জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে কম সময়ে মাঠে নামার রেকর্ড।
★ ২০১৮ সালে আইসিসি ওয়ানডে বোলিং র্যাংকিং এ শীর্ষস্থান দখল করেন রশিদ খান। একই বছর ওয়ানডে অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়েও শীর্ষে উঠে আসেন এই আফগান যুবা।
★ মাত্র ১৯ বছর ১৬৫ দিন বয়সে তিনি প্রথমবারের মতো এক ওয়ানডে ম্যাচে আফগানিস্তানের অধিনায়কত্ব করেন, যা সবথেকে কম বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অধিনায়ক হওয়ার রেকর্ড।
★ সর্বকনিষ্ঠ বোলার হিসেবে সবথেকে কম ম্যাচ খেলে ওয়ানডেতে ১০০তম উইকেট শিকারী বনে যান রশিদ খান। এজন্য তাকে মাত্র ৪৪ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে হয়।
★ দ্রুততম বোলার হিসেবে আন্তর্জাতিক টি টুয়েন্টিতে ৫০ উইকেট দখলের রেকর্ডও তার।
★ ২০১৮ সালে তিনি আইসিসি কর্তৃক সহযোগী দেশগুলোর সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হন এবং সে বছরই আন্তর্জাতিক টি টুয়েন্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বিশ্ব একাদশ দলে জায়গা পান।
★ ২০১৯ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এক টি টুয়েন্টি ম্যাচে তিনি হ্যাটট্রিকসহ চার বলে চার উইকেট লাভ করেন।
★নিজ দেশের প্রথম তথা উদ্ভোধনী টেস্ট ম্যাচে এক ইনিংসে সব থেকে খরুচে বোলিংয়ের রেকর্ড রশিদ খানের (১৫৪/২), প্রতিপক্ষ ভারত।
★ ২০১৯ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে এক ইনিংসে ৮২ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট তুলে নেন, যা তার টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথম পাঁচ উইকেট প্রাপ্তি। প্রথম আফগান ক্রিকেটার হিসেবে এ কীর্তি গড়ে আফগান ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় স্থায়ীভাবে ঠাঁই পেয়ে যান রশিদ খান।
★ বিশ্বকাপ ইতিহাসে সব থেকে খরুচে বোলিংয়ের রেকর্ড রশিদ খানের। ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই লজ্জার রেকর্ড গড়েন তিনি ( ৯ ওভারে ১১০ রান)!
★ ২০১৯ সালে অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের পথযাত্রার প্রথম ম্যাচেই জয়ের স্বাদ পান রশিদ। ২০ বছর ৩৫০ দিন বয়সে তিনি অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট খেলতে নামেন, যা একটি বিরল রেকর্ড। ২২৪ রানে বাংলাদেশকে নাকানি চুবানি খাইয়ে হারানোর সে ম্যাচে তিনি ব্যাট হাতে একটি হাফ সেঞ্চুরির পাশাপাশি বল হাতে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ১০ উইকেটের দেখা পান।
★ ২০১৭ সালে ৬০ উইকেট শিকার করে আইসিসির কোন সহযোগী দেশের হয়ে এক বছরে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হন তিনি।
★ সাকলাইন মুশতাককে পেছনে ফেলে সব থেকে কম বয়সে বোলিং র্যাংকিং এ শীর্ষে উঠার রেকর্ড নিজের করে নেন রশিদ খান।
রশিদ খানের প্রিয়-
★ ক্রিকেটার - শহীদ আফ্রিদি, ভিরাট কোহলি।
★ বোলিং স্টাইল - শহীদ আফ্রিদি, অনীল কুম্বলে।
★ গাড়ি - টয়োটা, বিএমডব্লিউ।
★ অভিনেতা - সালমান খান।
★ অভিনেত্রী - আনুষ্কা শর্মা, কারিনা কাপুর।
★ খাবার - পিৎজা, বলানি।
★ ফিল্ডিং পজিশন - মিড অফ, মিড অন।
★ যে রেকর্ড গড়তে চান - দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরি।
★ ভ্রমণস্থান - মালদ্বীপ।
★ অধিনায়ক - আসগর আফগান।
★ অ্যাপ - হোয়াটস অ্যাপ।
বিশ্বজুড়ে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট দাপিয়ে বেড়ানো রশিদ খানের ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সুযাত্রা মূলতঃ শুরু হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হাত ধরে। ফ্রাঞ্চাইজিটির মালিক নাফিসা কামালের সঙ্গে রশিদের বেশ সুসম্পর্ক বজায় রয়েছে। এমনকি কোন কারণে বিপিএল খেলতে না পারলেও কুমিল্লার জার্সি ঠিকই চেয়ে নেন রশিদ খান, যা সুুসম্পর্ক এবং কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ।
বয়সের কারণে বরাবরই ট্রলের শিকার হওয়া এই ক্রিকেটার যেভাবে মাঠে নিজেকে উজাড় করে দেন, তাতে ক্যারিয়ারের ক্রান্তিলগ্নে যে একঝাঁক রেকর্ডে বেষ্টিত কিংবদন্তি হয়ে অবসরে যাবেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আফগান ক্রিকেটের এই দূতের হাত ধরেই শান্তির ফুল ফুটুক গোটা আফগান মুলুকে, সেই প্রার্থনাই করি।