"আমার স্পষ্ট মনে আছে, যখন আমার বান্ধবী কাজে যেত, আমি চুপচাপ সোফায় বসে কাঁদতাম। শুধু মনে হতো, সবাইকে হতাশ করছি আমি। লম্বা সময় ধরে রান পাচ্ছিলাম না। খেতে পারতাম না, ঘুমাতে পারতাম না। ইঞ্জুরির ভয় এতটাই জেঁকে বসেছিল যে মাঠে নামার আগেই আঘাত পাওয়ার ভয়ে বিপর্যস্ত থাকতাম। আমার খেলার সময় এলেই মনে মনে ভাবতাম ক্রিকেট আমার দ্বারা হবে না। ব্যাটিংয়ে নেমে কি লাভ, আমি তো ব্যর্থ হবোই। কেউ জানতো না আমি ঠিক কতটা কঠিন মূহুর্তের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম।"
কথাগুলো বছরখানেক আগে এক সাক্ষাতকারে গড়গড়িয়ে বলছিলেন অজি টেস্ট অধিনায়ক টিম পেইন। ২০১০ সাল থেকে বারবার আঙ্গুলের ইঞ্জুরিতে পড়ে ক্রিকেট থেকেই যেন ছিটকে গিয়ে গিয়েছিলেন, যার প্রভাব পড়েছিল দৈনন্দিন জীবনেও। মানসিক অবসাদ সর্বদা তাড়া করে বেড়াতো, বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল ক্রিকেটের প্রতি। ব্যাট - প্যাড চিরতরে তুলে ফেলার প্রয়াসে খেলা সরঞ্জাম তৈরির প্রতিষ্ঠান 'কোকাবুরা' তে চাকুরিও ঠিক করে ফেলেছিলেন। কিন্তু, মানুষের ভাগ্য বলেও তো একটা কথা আছে! সৃষ্টিকর্তা অজি দলে টিম পেইনের রাজসিক প্রত্যাবর্তন ভাগ্যলিপিতে লিখে রেখেছিলেন বলেই হয়তো তাকে আজ অজি দলের নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
টিমোথি ডেভিড পেইন, সর্তীর্থরা যাকে বাচ্চাসুলভ চেহারা এবং অল্প বয়সে সিনিয়র দলে খেলার সুবাদে 'কিড' বলে ডাকতেন। তাসমানিয়ার হোবার্টে সমুদ্র সৈকতের কোলঘেষা বাড়িতেই ১৯৮৪ সালের ৮ ডিসেম্বর জন্ম নেন টিম পেইন। পরিবারে ক্রীড়াচর্চা সবসময়ই ছিল। চার ভাইবোনের দুইজনই ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চাচা রবার্ট শ'ও ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল লীগের খেলোয়াড় এবং কোচের ভূমিকায়। ছোটবেলায় সৈকতে গিয়ে বিচ ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলেই অধিকাংশ সময় কাটতো তার।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট একাডেমিতে শিক্ষানবিশ থাকা অবস্থায়ই মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১০,০০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলারের বিনিময়ে রাজ্যদল তাসমানিয়ার 'Rookie Contract' এর আওতায় আসেন তিনি, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে এখন পর্যন্ত যা রেকর্ড। বয়স পনেরো পার না হতেই তাসমানিয়া অনুর্ধ্ব-১৯ দলে খেলে ফেললেন। শুধু তাই নয়, সে বয়সেই তাসমানিয়া অনুর্ধ্ব-১৫ এবং অনুর্ধ্ব-১৭ দলে দারুণ অধিনায়কত্ব করে দলকে লাগাতার সফলতা উপহার দিতে লাগলেন। নির্বাচকরা ততদিনে তাকে ঘিরে বহু পরিকল্পনা এঁটে ফেলেছেন , কেউ কেউ তো তাকে ভবিষ্যৎ অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়কই ঘোষণা করে দিলেন।
২০০৩ সালের ডিসেম্বর। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া আসন্ন ২০০৪ অনুর্ধ্ব- ১৯ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে তাদের বিশ্বকাপ দল ঘোষণা করে। অধিনায়কের দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হয় টিম পেইনের কাঁধে। মূলতঃ অস্ট্রেলিয়া তাকে ভবিষ্যৎ জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রস্তুত করার জন্যই বাজিয়ে দেখে অভিজ্ঞ করতে চাচ্ছিল। যাইহোক, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া সেবারের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে পেইনের অস্ট্রেলিয়াকে প্লেট চ্যাম্পিয়নশিপের রানার আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বাংলাদেশের স্পিনিং উইকেটে তার ব্যাট থেকে ২৩.৬৬ গড়ে আসে ১৪২ রান। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই বিশ্বকাপে উইকেট কিপিং এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই তাকে বোলারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। ফলস্বরূপ, ৮ টি ম্যাচে মিডিয়াম ফাস্ট বোলিংয়ের দ্বারা ২২.২৮ গড়ে সংগ্রহ করেছিলেন ৭ উইকেট!
২০০৫ সাল। তাসমানিয়ার হয়ে ফার্স্ট ক্লাস এবং লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে যায় টিম পেইনের। স্পেশালিস্ট ওপেনার হিসেবে শুরুটা একদমই বাজে হয় তার, অভিষেক ইনিংসেই শুন্য রানে প্যাভিলিয়নের পথ ধরতে হয়। তবে নিজেকে প্রমাণ করতে খুব বেশি সময় নেননি তিনি। অভিষেকের দিনকয়েক পরই লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করে নিজের প্রতিভার জানান দেন। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটেও নিজের জাত চেনাতে শুরু করেন পেইন, ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো দেখা পেয়ে যান ডাবল সেঞ্চুরির। ২০০৬-০৭ মৌসুমে তাসমানিয়ার হয়ে লিস্ট 'এ' ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান স্কোরার বনে যান সবার প্রিয় 'কিড'।
২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবেই তাসমানিয়ার হয়ে খেলে গেছেন পেইন। তবে ২০০৭ সালে নিয়মিত উইকেট কিপার শেন ক্লিংগ্লেফার অবসর গ্রহন করলে তাসমানিয়ার মূল উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব বর্তায় টিম পেইনের ওপর। উইকেটরক্ষক - ব্যাটসম্যান হিসেবে তাসমানিয়া দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠেন তিনি।
২০০৯ সালে সদ্য সমাপ্ত অ্যাশেজ শেষে যখন ওয়ানডে সিরিজের প্রস্তুতি নিচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া দল, ঠিক সেসময়ই নিয়মিত উইকেটরক্ষক ব্রাড হাডিন ইঞ্জুরিতে পড়ে দেশে ফিরে আসেন। ফলশ্রুতিতে, ওয়ানডে সিরিজের জন্য প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পড়ে টিম পেইনের।
২৮ আগস্ট, ২০০৯। অস্ট্রেলিয়ার রঙ্গিন জার্সি গায়ে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন পেইন। দিন দুয়েক পরই অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিষেক ঘটে যায় তার। অভিষেকের দিন কয়েকের মাঝেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তুলে নেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ড সফর শেষে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের ওয়ানডে দলেও জায়গা পেয়ে যান। কিন্তু নাগপুরে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে ম্যাচে ক্যাচ ধরতে গিয়ে আঙ্গুল ভেঙ্গে যায় তার। বিপত্তির শুরুটা হয় এখানেই!
আঙ্গুলের ইঞ্জুরি কাটিয়ে ২০০৯-১০ মৌসুমে ফিরে তাসমানিয়ার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন টিম পেইন। তবে জাতীয় দলে যেন সুযোগ মিলছিলনা। ২০১০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ব্রাড হাডিন ইঞ্জুরির কবলে দল থেকে ছিটকে গেলে জাতীয় দলের দরজা আবারও খুলে যায় পেইনের জন্য। প্রথমবারের মতো 'ব্যাগি গ্রিন' ক্যাপে সাদা পোশাকের রাজকীয় ফর্মেটে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক ঘটে তার। এরপর ভারত সফরেও হাডিনের অনুপস্থিতিতে খেলে ফেলেন দুটি টেস্ট। তবে সাদা পোশাকে ব্যাট হাতে তেমন সুবিধা করতে না পারলেও উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে ঠিকই নিজেকে অসাধারণ প্রমাণ করতে থাকেন। এসময়টাতেই রিকি পন্টিংয়ের অবসরের পর 'ভবিষ্যৎ অধিনায়ক' হিসেবে পেইনকে দায়িত্ব দেওয়া হোক- এমন আলোচনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয় বয়সভিত্তিক দলে পেইনের অর্জিত অভিজ্ঞতাকে।
৭ জানুয়ারী, ২০১১। অস্ট্রেলিয়া টি - টুয়েন্টি দলের সহ অধিনায়ক হিসেবে টিম পেইনের নাম ঘোষণা করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া 'এ' দলের দায়িত্বভারও তুলে দেওয়া হয় তার কাঁধে। আইপিএলে পুনে ওয়ারিয়র্স তাকে কিনে নেয় ২,৭০,০০০ ডলারের বিনিময়ে। অ্যাডাম গিলক্রিস্টের অবসরের পর যখন ব্রাড হাডিন উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব সামলাচ্ছিল, ঠিক তখনই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া টিম পেইনকে তাদের ভবিষ্যৎ কান্ডারীরূপে তৈরি করার মিশনে নেমেছিল। তবে সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যায় যখন তিনি ২০১১ সালে আবারও আঙ্গুলের ইঞ্জুরিতে পড়েন। এবার যেন আঙ্গুলের ইঞ্জুরি একদম শেষই করে দিচ্ছিল তাকে। সাতবার অস্ত্রোপচার করা হলো অথচ কিছুতেই পুরোপুরি সেরে উঠছিলেননা। মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙ্গে পড়লেন, প্রভাব পড়লো মাঠের পারফরম্যান্সেও। আস্তে আস্তে জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে গেলেন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও দলে জায়গা হারালেন। মানসিকভাবে এতটাই ভেঙ্গে পড়লেন যে মনোবিদের শরণাপন্ন হতে হলো।
২০১২ থেকে ২০১৭, এই ছয় বছর ছিল পেইনের জীবনের দূর্বিষহ ছয়টি বছর। রাগে - দুঃখে - হতাশায় যখন ক্রিকেট ছেড়ে কোকাবুরায় চাকরির বন্দোবস্ত করলেন ঠিক তখনই মন বলে উঠলো- আর একবার চেষ্টা করে দেখিনা,কি হয়! কথায় আছে, সবুরে মেওয়া ফলে, ধৈর্য্যের ফল সুমিষ্ট হয়। পেইনের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটেছিল। ২০১৭-১৮ অ্যাশেজ সিরিজের পূর্বে উইকেটরক্ষক হিসেবে যখন পিটার নেভিল এবং ম্যাথু ওয়েড নির্বাচকদের আস্থাভাজন হয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই তাসমানিয়ার সাবেক কোচ অ্যাডাম গ্রিফিত নির্বাচকদের স্মরণ করিয়ে দেন টিম পেইনের কথা।
দীর্ঘ ছয় বছর অস্ট্রেলিয়া দলে ডাক পড়ে পেইনের, তাও আবার অ্যাশেজ সিরিজে! পেইনকে দলে ভেড়ানোয় ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। সমালোচনা হবেই বা না কেন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তখন একদমই অনিয়মিত ছিলেন টিম পেইন, সর্বশেষ প্রথম শ্রেণির সেঞ্চুরিও এসেছে সেই ২০০৬ সালে, তৎকালীন কোচ লেহম্যানেরও এরপর সেঞ্চুরি আছে! এতকিছুর পরও তার ওপরই আস্থা রাখলেন নির্বাচকরা। আস্থার প্রমাণ দিতে আবারও যেন পুরোনো শাণিত রূপে ফিরে গেলেন তিনি। ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়ে ফিরে এলেন ওয়ানডে এবং টি - টুয়েন্টি ফর্মেটেও!
২০১৮ সালে বল টেম্পারিং কান্ডে অধিনায়ক স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার এবং ক্যামেরুন ব্যানক্রফটকে নিষিদ্ধ করা হলে অজি টেস্ট দলের অধিনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন টিম পেইন। স্মিথের অনুপস্থিতিতে পুনরায় অস্ট্রেলিয়া দলকে চাঙ্গা করে সফলতার ধারা অব্যাহত রাখেন তিনি। এখন পর্যন্ত ২০ টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছেন পেইন, যেখানে জয় এসেছে ১১ টি ম্যাচে, বিপরীতে হার ৬ টি ম্যাচে, বাকি ৩ টি ড্র!
অধিনায়ক হিসেবে দারুণ ভূমিকা পালন করা পেইন ভারতের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টেও উইকেটের পেছনে ইনিংসে পাঁচ ক্যাচসহ ম্যাচে নিয়েছেন সাত ক্যাচ! পাশাপাশি ব্যাট হাতে দলের বিপর্যয়ে অপরাজিত ৭২ রানের নান্দনিক ইনিংস খেলে জিতে নিয়েছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।
ক্যারিয়ার শেষে টিম পেইনের নামটা বিশ্বসেরা উইকেটকিপারদের পাশে থাকবে কি না, কে জানে! তবে অজি কাপ্তান অন্তত একটি জায়গায় সবার ওপরে লিখে নিলেন নিজের নাম। গতকাল মেলবোর্নে ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় দিনে ১৫০ ডিসমিসালের মাইলফলক ছুঁয়েছেন পেইন। এজন্য তাকে খেলতে হয়েছে মাত্র ৩৩ ম্যাচ। এ যাত্রায় পেইন ভেঙেছেন প্রোটিয়া উইকেটরক্ষক কুইন্টন ডি ককের রেকর্ড (৩৪ ম্যাচ)।
বাস্তবজীবনে দুর্বিষহ সব 'পেইন' সহ্য করা টিম পেইন স্লেজিংয়ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের মনোবল দূর্বল করে 'পেইন' দিতেও দারুণ পটু। বাস্তব জীবনের এই 'পেইন' কিলারের বৈচিত্রময় জীবন নিয়ে চাইলে সিনেমাও বানিয়ে ফেলা যায়। সত্যিই বড্ড বিচিত্র টিম পেইন!