নব্বই দশকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করা খেলোয়াড়েরা প্রায় সবাই ক্রিকেটের পাঠ চুকিয়ে কোচ, আম্পায়ার, ধারাভাষ্যকার কিংবা অন্যান্য পেশায় জড়িয়ে গেছেন। ব্যতিক্রম, শোয়েব মালিক। তিনি ১৯৯০, ২০০০, ২০১০ ও ২০২০ - এই চারটি দশকেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার অন্যতম সাক্ষী। পাকিস্তানের এই সুদর্শন অলরাউন্ডার এখনও তরুণদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন, বিশেষ করে টি টুয়েন্টি ফর্ম্যাটে এখনও তিনি হট কেক!
সদ্য ৪০ বছর পূর্ণ করে ৪১ এ পদার্পণ করা শোয়েব মালিকের ছোটবেলায় ক্রিকেট যাত্রা শুরু হয়েছিল টেপ টেনিস বলে। পরিবার থেকে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করার চাপ থাকলেও তার ধ্যানজ্ঞান পুরোটাই ছিল ক্রিকেটকেন্দ্রিক। অবশ্য তার বাবার এতে কোন আপত্তি ছিলনা। অবশেষে তার জেদের কাছে হার মেনে পরিবার থেকে তাকে ক্রিকেট শেখার জন্য ভর্তি করে দেওয়া হয় শিয়ালকোটে অবস্থিত ইমরান খানের কোচিং ক্লিনিকে। সেখানে তার পাঠ শুরু হয় মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে, যদিও ধীরে ধীরে বোলিংয়ের প্রতি তার ঝোঁক বাড়ে। সেখানে শিক্ষানবিশ থাকা অবস্থায় দুই বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তার ডাক পড়ে পাকিস্তান অনুর্ধ্ব ১৫ দলে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্কোয়াডে তিনি একজন বোলার হিসেবে ডাক পান।
বয়সভিত্তিক দলে ভাল পারফরম্যান্স করার সুবাদে মাত্র ১৮ বছর বয়সে জাতীয় দলের দরজা তার জন্য খুলে যায়। ১৪ অক্টোবর, ১৯৯৯। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রঙ্গিন পোশাকে অভিষেক ঘটে মালিকের। সেদিন ব্যাট হাতে সুযোগ না পেলেও বোলিংয়ে ৮ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৩৪ রানের বিনিময়ে শিকার করেন ২ উইকেট। পরবর্তীতে ২০০০ সালে সিঙ্গার ট্রায়াঙ্গুলার সিরিজে ব্যাটিয়ের সুযোগ মিলে মালিকের। নয় নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে না পারলেও বল হাতে ২৮ রানে দুই উইকেট তুলে নেন। এর পরের বছরই অর্থাৎ ২০০১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে তার টেস্ট অভিষেক ঘটে যায়। চলুন দেখে নেওয়া যাক শোয়েব মালিকের অর্জন, পরিসংখ্যান, রেকর্ড এবং অন্যান্য-
★ ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার এই ব্যাটিং অলরাউন্ডার বিশ্বের সর্বপ্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ১০০ টি আন্তর্জাতিক টি টুয়েন্টি খেলার রেকর্ড স্পর্শ করেন। পাশাপাশি প্রথম এশিয়ান ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক টি টুয়েন্টিতে ২ হাজার রান করার রেকর্ডটিও তার দখলে।
★ মালিক তার ক্যারিয়ারে ৩৫ টি টেস্টে ৩৫. ১৪ গড়ে করেছেন ১,৮৯৮ রান (সেঞ্চুরি ৩টি, হাফ সেঞ্চুরি ৮ টি, সর্বোচ্চ ২৪৫)। বল হাতে এ ফর্ম্যাটে তার শিকার ৪৭.৪৬ গড়ে ৩২ উইকেট (সেরা ৪/৩৩)। ২০১৫ সালে টেস্ট ক্রিকেট থেকে তিনি অবসর গ্রহন করেন।
★ রঙ্গিন পোশাকের ওয়ানডে ক্রিকেটে ২৮৭ টি ম্যাচে অংশ নিয়ে ব্যাট হাতে তার সংগ্রহ ৩৪.৫০ গড়ে ৭,৫৩৪ রান ( সেঞ্চুরি ৯ টি, হাফ সেঞ্চুরি ৪৪ টি, সর্বোচ্চ ১৪৩)। অপরদিকে বল হাতে তার শিকার ৩৯.২০ গড়ে ১৫৮ উইকেট (সেরা ৪/১৯)।
উল্লেখ্য, ২০১৯ বিশ্বকাপের পর তিনি ওয়ানডে থেকে অবসর গ্রহন করেন।
★ টি টুয়েন্টি ফর্ম্যাটের একজন কিংবদন্তিতুল্য ক্রিকেটার হিসেবে গণ্য করা হয় শোয়েব মালিককে। পাকিস্তান এবং বিশ্ব একাদশের হয়ে এখন পর্যন্ত তিনি মোট ১১৬ টি আন্তর্জাতিক টি টুয়েন্টি খেলেছেন, যেখানে ব্যাট হাতে তার সংগ্রহ ৩১.১৩ গড়ে ২,৩৩৫ রান ( সর্বোচ্চ ৭৫)। বল হাতেও তিনি কম যাননা। ডানহাতি অফ স্পিনে ২৩.৫৩ গড়ে ২৮ উইকেট শিকার (সেরা ২/৭) কিন্তু সে কথাই বলে।
★ সবধরনের স্বীকৃত টি টুয়েন্টি মিলিয়ে ৩৯৫ টি ম্যাচে অংশ নিয়ে ১০ হাজারের ওপর রান করার কৃতিত্ব আছে শোয়েব মালিকের, আছে দুইবার ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার গৌরব।
★ এখন পর্যন্ত স্বীকৃত ক্রিকেটে ৪৫ টি ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১ থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত প্রতিটি ব্যাটিং অর্ডারেই ব্যাট করার বিরল কৃতিত্ব রয়েছে তার দখলে।
★ ২১ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে বহুবার দল থেকে বাদ পড়ে আবার ফিরে আসার নজির আছে তার। এমনকি অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের দায়ে বহুবার অভিযুক্ত হয়েছেন তিনি।
★ ২০০৭ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ভরাডুবির পর ক্যাপ্টেন্সির বাটন তুলে দেওয়ার কথা ছিল ইউনিস খানের হাতে। কিন্তু ইউনিস এতে অস্বীকৃতি জানালে ক্যাপ্টেন হিসেবে নির্বাচন করা হয় শোয়েব মালিককে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হয়ে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান দলের অধিনায়কত্ব করেন।
★ অধিনায়ক হিসেবে মালিকের অর্জন ছিল ৩ টেস্টে ২ হার, ১ ড্র। ওয়ানডেতে ৩৬ ম্যাচে ২৪ জয়ের বিপরীতে ১২ হার এবং টি টুয়েন্টিতে ১৭ ম্যাচে ১২ জয় ও ৫ হার। পরবর্তীতে ২০১৮-১৯ মৌসুমে সরফরাজ আহমেদ বর্ণবাদী মন্তব্যের জেরে শাস্তির মুখে পড়লে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ২ টি ওয়ানডে ও ৩ টি টুয়েন্টি ম্যাচে নেতৃত্ব দেন তিনি।
★ ২০০৭ টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপের টুর্নামেন্ট সেরা একাদশে স্থান পেয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ২০০৯ সালে সেঞ্চুরিওনে ভারতের বিপক্ষে খেলা ১২৮ রানের ইনিংসটি সেবছর ESPNCricinfo জরিপে 'Best ODI Batting Performance of the Year' নির্বাচিত হয়।
★ ২০০৯ টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপাজয়ী পাকিস্তান দলের সদস্য ছিলেন তিনি। এছাড়া ক্লাব ক্রিকেটে ১৪ বার হয়েছেন শিরোপাধারী দলের সদস্য।
★ স্ত্রী বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় সানিয়া মির্জার সাথে মাত্র ৪ মাসের প্রেম পরিণয়ে গড়ায় ২০১০ সালে। ২০১৮ সালে শোয়েব মালিক প্রথমবারের মতো বাবা হন। স্ত্রী সানিয়া রান্নাবান্না না পারায় রান্নার দায়িত্ব নিজেই নিয়ে নেন শোয়েব মালিক। এছাড়া 'স্থান দুবাই' নামক এক রেস্তোরায় শোয়েব মালিকের জন্য আলাদা একটি মেন্যুই বরাদ্দ আছে। যার নাম 'চিকেন ৬৫' ( মুরগির তৈরি এক ধরণের কাবাব)।
★ ক্রিকেটার না হলে তিনি প্রফেশনাল কার রেসার হতেন। স্পোর্টস কারগুলোর প্রতি তার রয়েছে ভীষণ দূর্বলতা। 'Fast and Furious' সিরিজের প্রচন্ড ভক্ত তিনি।